জানাজার নামাজের দোয়া

জানাজার নামাজের নিয়ম, নিয়ত, দোয়া ও ফজিলত

জানাজার নামাজ ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় রীতি। জানাজার নামাজ মূলত মৃত ব্যক্তির জন্য দোয়া করা হয় যাতে আল্লাহ তায়ালা তাকে ক্ষমা করেন এবং তার আত্মাকে শান্তি দেন। এই নামাজটি মৃতের জন্য হেদায়াত, মাগফিরাত এবং দয়া প্রার্থনার উদ্দেশ্যে করা হয়।

জানাজার নামাজের নিয়ম বাংলায়

জানাজার নামাজ একটি গুরুত্বপূর্ণ নামাজ যা কোনো মুসলিমের মৃত্যুর পর তার জন্য দোয়া ও মাগফেরাতের উদ্দেশ্যে পড়া হয়। নিচে জানাজার নামাজের নিয়ম বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হলো:

মৃত ব্যক্তিকে সামনে রাখা: মৃত ব্যক্তিকে একটি খাটিয়ায় ওপর উত্তর-দক্ষিণ দিকে মুখ করে রাখতে হবে।

ইমামের অবস্থান: ইমাম মৃত ব্যক্তির বুকের বরাবর সামনে দাঁড়াবেন এবং মুক্তাদিরা তার পেছনে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়াবেন।

জানাজার নামাজের নিয়ত

জানাজার নামাজের জন্য নিয়ত মনে মনে করতে হয়, মুখে উচ্চারণ করা জরুরি নয়। তবে বুঝার সুবিধার্থে নিচে আরবি, বাংলা উচ্চারণ এবং অর্থসহ দেওয়া হলো।

জানাজার নামাজের নিয়ত বাংলা উচ্চারণ

আরো পড়ুন: তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ম, নিয়ত ও ফজিলত

বাংলা অর্থ: “আমি আল্লাহর জন্য চার তাকবিরের সাথে জানাযার নামাজ, ফরজে কেফায়া আদায় করার নিয়ত করলাম। আল্লাহ তাআলার প্রশংসা এবং নবীর প্রতি দরূদ ও এই মৃত ব্যক্তির জন্য দোয়া করছি, এই ইমামের পিছনে কাবার দিকে মুখ করে। আল্লাহু আকবার।”

*** এখানে “লেহাযাল মাইয়্যেতে” শব্দটি পুরুষ লাশের জন্য ব্যবহৃত হয়। যদি মৃত ব্যক্তি নারী হয়, তবে “লেহাযিহিল মাইয়্যেতে” ব্যবহার করতে হবে।

প্রথম তাকবির: ইমাম “আল্লাহু আকবর” বলে তাকবির বলবেন এবং মুক্তাদিরাও একই সাথে তাকবির বলবেন। তাকবির বলার সময় হাত কাঁধ পর্যন্ত উঠানো উত্তম। যদি কেউ ভুলে না উঠায় সেক্ষেত্রে সমস্যা হবেনা।

সানা পড়া: প্রথম তাকবিরের পর ইমাম এবং মুক্তাদি উভয়েই সানা পড়বেন। সানা টি নিচে আরবি বাংলা উচ্চারণ এবং অর্থসহ দেওয়া হলো-

জানাজার নামাজের নিয়ত, দোয়া ও ফজিলত

আরো পড়ুন: আয়তনে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মুসলিম দেশ

দ্বিতীয় তাকবির: ইমাম দ্বিতীয় তাকবির বলবেন এবং মুক্তাদিরাও একই সাথে তাকবির বলবেন।

দরুদ: দ্বিতীয় তাকবিরের পর ইমাম এবং মুক্তাদি উভয়েই দরুদ শরিফ পড়বেন। দরুদ শরিফ আরবি বাংলা উচ্চারণ এবং অর্থসহ নিচে আলোচনা করা হলো-

দরুদ শরীফ আরবি বাংলা উচ্চারণ এবং অর্থসহ

বাংলা অর্থ: অর্থ: হে আল্লাহ! মুহাম্মদের ওপর এবং তার পরিবারের ওপর রহমত বর্ষণ করুন, যেমন আপনি ইব্রাহীমের ওপর এবং তার পরিবারের ওপর রহমত বর্ষণ করেছেন। নিশ্চয়ই আপনি প্রশংসিত, মহিমান্বিত। হে আল্লাহ! মুহাম্মদের ওপর এবং তার পরিবারের ওপর বরকত বর্ষণ করুন, যেমন আপনি ইব্রাহীমের ওপর এবং তার পরিবারের ওপর বরকত বর্ষণ করেছেন। নিশ্চয়ই আপনি প্রশংসিত, মহিমান্বিত।

তৃতীয় তাকবির: ইমাম তৃতীয় তাকবির বলবেন এবং মুক্তাদিরাও একই সাথে তাকবির বলবেন। তৃতীয় তাকবিরের পর ইমাম এবং মুক্তাদি উভয়েই মৃত ব্যক্তির জন্য দোয়া করবেন।

চতুর্থ তাকবির: ইমাম চতুর্থ তাকবির বলবেন এবং মুক্তাদিরাও একই সাথে তাকবির বলবেন।

জানাজার নামাজের দোয়া

জানাজার নামাজে তৃতীয় তাকবিরের পর মৃত ব্যক্তির জন্য বিশেষ দোয়া পড়া হয়। এটি নবী মুহাম্মদ (সাঃ) থেকে বর্ণিত অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দোয়া। এটিকে জানাজার নামাজের তৃতীয় দোয়া ও বলা হয়ে থাকে। নিচে যাজানার নামাজের দোয়া আরবিতে বাংলা উচ্চারণ এবং অর্থসহ দেওয়া হলো-

জানাজার নামাজের ফজিলত

অর্থ : হে আল্লাহ, আমাদের জীবিত এবং মৃতদের, উপস্থিত এবং গায়েবদের, ছোট ও বড়দের এবং আমাদের নারী-পুরুষ সবাইকে ক্ষমা করুন। হে আল্লাহ, আপনি আমাদের মধ্য থেকে যাকে জীবিত রাখবেন তাকে ইসলামের ওপরই জীবিত রাখুন। যাকে মৃত্যু দান করবেন তাকে ইমানের সাঙ্গেই মৃত্যু দিন। হে আল্লাহ! এর সাওয়াব থেকে আমাদেরকে বঞ্চিত করবেন না এবং এর পর আমাদেরকে পথভ্রষ্ট করবেন না।

জানাজার নামাজের দোয়া মৃত ব্যক্তির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।আল্লাহ আমাদের সবাইকে জানাজার দোয়া পড়ার তাওফিক দান করুন।

আরো পড়ুন: পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো মানুষ কে

গায়েবানা জানাজা

গায়েবানা জানাজা বলতে বোঝায় এমন একজন মৃত ব্যক্তির জন্য জানাজার নামাজ পড়া, যার মৃতদেহ সেখানে উপস্থিত নেই। সাধারণত দূর দেশে বা দূরে কোথাও মারা যাওয়া ব্যক্তিদের জন্য এই নামাজ পড়ার বিধান রয়েছে।

গায়েবানা জানাজার নিয়ে একটি হাদিস রয়েছে-

মহানবী (সাঃ) নাজাশী (হাবশার রাজা) মারা যাওয়ার পর, তার জানাজার নামাজ গায়েবানা পড়েছিলেন। (সহিহ বুখারি: ১৩৩৩, সহিহ মুসলিম: ৯৫১)

গায়েবানা জানাজা একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত, যদি মৃত ব্যক্তির জানাজার নামাজ পড়া না হয় এবং দূর দেশে মারা যান, তবে গায়েবানা জানাজা আদায় করা যায়।

জানাজার নামাজের ফজিলত

জানাজার নামাজএকটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত, যার মাধ্যেমে মৃত ব্যক্তির জন্য দোয়া ও মাগফিরাতের কামনা করা হয়। নিচে জানাজার নামাজের গুরুত্ব ও ফজিলত আলোচনা করা হয়েছে-

জানাজার নামাজ পড়ার মাধ্যমে বিশাল সওয়াব অর্জন

রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন

“যে ব্যক্তি জানাজার নামাজ পড়ে, সে কিরাত পরিমাণ সওয়াব লাভ করবে। আর যে ব্যক্তি দাফন পর্যন্ত উপস্থিত থাকে, সে দুই কিরাত পরিমাণ সওয়াব লাভ করবে। সাহাবিরা জিজ্ঞাসা করলেন, “হে আল্লাহর রাসুল! কিরাত কী?
তিনি বললেন, “দুটো বিশাল পাহাড়ের সমান।”
(সহিহ বুখারি: ১৩২৫, সহিহ মুসলিম: ৯৪৫)

জানাজার নামাজ মুসলমানদের উপর হক

জানাজার নামাজ একজন মুসলিমের উপর আরেক মুসলিমের কর্তব্য ও দায়িত্ব। এটি আদায় করে একজন মুসলমান তার ধর্মীয় ও সামাজিক দায়িত্ব পালন করে।

জানাজার নামাজ পড়লে মৃত্যুর কথা স্মরণ হয়

এটি জীবিতদের মৃত্যুর কথা স্মরণ করিয়ে দেয় এবং তাদের আমল ঠিক করার তাগিদ দেয়। এটি মানুষকে গুনাহ থেকে দূরে রাখে এবং নেক আমলের প্রতি আগ্রহী করে তোলে।

নবী (সাঃ) বলেছেন:

“তোমরা বেশি বেশি মৃত্যুর কথা স্মরণ করো, কারণ এটি গুনাহ থেকে বিরত রাখে এবং আখিরাতের জন্য প্রস্তুত হতে সাহায্য করে।”
(সুনান ইবনে মাজাহ: ৪২৫৮)

জানাজার নামাজ শুধু মৃত ব্যক্তির জন্য নয়, এটি জীবিতদের জন্যও শিক্ষা ও ফজিলতের মাধ্যম।

জানাজার নামাজ প্রশ্ন এবং উত্তর

মহিলারা কি জানাজার নামাজ পড়তে পারবে

জি হ্যাঁ, মহিলারা জানাজার নামাজ পড়তে পারবেন।মহিলাদের জন্য জানাজার নামাজ পড়া জায়েজ এবং শরিয়তের দৃষ্টিতে এতে কোনো বাধা নেই। তবে তাদের জন্য জানাজার নামাজ পড়া বাধ্যতামূলক নয়, বরং মুস্তাহাব।

নবীজির জানাজার নামাজ কে ইমামতি করেছিলেন

রাসুল সাঃ এর জানাজার নামাজ কে পড়ায় এমন প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে- সুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর জানাজার নামাজ সাধারণ জানাজার নামাজের মতো হয়নি। এটি একটু ব্যতিক্রম পদ্ধতিতে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) এর জানাজার নামাজ কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তি দ্বারা পরিচালিত হয়নি। তাঁর মৃত্যুর পর সাহাবীরা ব্যক্তিগতভাবে জানাজার নামাজ পড়েন।

নবীর জানাজার নামাজ কেন হয়নি

রাসুলুল্লাহ (সাঃ) উম্মতের ইমাম ছিলেন, তাই তার জানাজার নামাজে কোনো ব্যক্তি ইমামতি করেননি। সাহাবিরা একে একে দলে দলে প্রবেশ করে জানাজার নামাজ আদায় করেন এবং দোয়া করেন।

জুতা পায়ে জানাজার নামাজ পড়ার যাবে

জুতা পায়ে জানাজার নামাজ পড়া জায়েজ। তবে এক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে আপনার জুতা ও পায়ের নিচের মাটি  পবিত্র থাকতে হবে, তাহলেই জুতা পরেই জানাজার নামাজ  কোন বাধা নেই।

স্বপ্নে জানাজার নামাজ পড়তে দেখলে কি হয়

স্বপ্নে জানাজার নামাজ পড়া বিভিন্ন দিক থেকে বিভিন্ন অর্থ বহন করতে পারে, এবং তা স্বপ্নদৃষ্টির পরিস্থিতি ও বাস্তব জীবনের প্রেক্ষাপটের ওপর নির্ভর করে।

  • আত্মবিকাশ ও আত্মবিশ্লেষণ
  • দুনিয়াতে মৃতের জন্য দোয়া বা মাগফিরাতের ইঙ্গিত
  • জীবনের এক অধ্যায়ের শেষ
  • দুঃখ ও শোকের সময়

ইসলামের মধ্যে স্বপ্নের ব্যাখ্যা করা কঠিন, জানাজার নামাজ সাধারণত মৃত ব্যক্তির জন্য হয়, এটি মৃত্যু, জীবনের সমাপ্তি, শোক, তাওবা, ক্ষমা এবং আখিরাতের প্রস্তুতি সম্পর্কিত কিছু প্রতীক হতে পারে।

জানাজার নামাজ ফরজ নাকি ওয়াজিব

জানাজার নামাজ হলো “ফরজে কেফায়া। মুসলমানদের মধ্যে যদি কিছু লোক এই নামাজ আদায় করে, তাহলে বাকিদের দায়িত্ব আদায় হয়ে যায়। কিন্তু যদি কেউই আদায় না করে, তাহলে সমাজের সকলেই গুনাহগার হবে।

উপসংহার

জানাজার নামাজের মাধ্যমে আমরা মৃত ব্যক্তির জন্য দোয়া করি, তার গুনাহ মাফ চেয়ে আল্লাহর রহমত কামনা করি। জানাজার নামাজের গুরুত্ব অনস্বীকার্য, এবং এটি মুসলমানদের ওপর একটি ঐক্যবদ্ধ কর্তব্য। আমাদের সকলের উচিত, জানাজার নামাজকে উপেক্ষা না করা। আল্লাহ আমাদের সবাইকে জানাজার নামাজের মতো গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত সঠিকভাবে পালন করার তাওফিক দান করুন।

Share this

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *