তাহাজ্জুদ নামাজ Tahajjud Namaz
তাহাজ্জুদ” শব্দটি আরবি “হুজুদ” থেকে এসেছে, যার অর্থ ঘুমানো এবং “তাহাজ্জুদ” অর্থ ঘুম ত্যাগ করা। তাহাজ্জুদ নামাজ হলো এক বিশেষ নফল ইবাদত, যা রাতের শেষ অংশে ঘুম থেকে জেগে আদায় করা হয়। এটি আল্লাহর কাছে নৈকট্য লাভের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপায় এবং হযরত মুহাম্মদ (সা.) বিশেষভাবে এ নামাজ আদায় করতেন ও উম্মতকে উৎসাহিত করেছেন।
তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ম
তাহাজ্জুদ নামাজ হলো একটি গুরুত্বপূর্ণ নফল ইবাদত, যা গভীর রাতে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য আদায় করা হয়। এটি এশার নামাজের পর এবং ফজরের আজানের আগে পড়া যায়, তবে উত্তম হচ্ছে রাতের শেষ ভাগে। নিচে তাহাজ্জুদ নামাজের পড়ার সঠিক নিয়ম তুলে ধরা হলো—
তাহাজ্জুদ নামাজের সময়
রাতের শেষ তৃতীয়াংশ থেকে ফজর হওয়ার আগ পর্যন্ত তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ার উত্তম সময়। তাহাজ্জুদ নামাজের মাধ্যমে বান্দা আল্লাহর খুব কাছাকাছি চলে যায়।
ইশার নামাজের পর
- এশার নামাজ আদায় করার পর তাহাজ্জুদ নামাজ পড়া যায়।
- কেউ চাইলে ইশার পর কিছু সময় জেগে থেকে তাহাজ্জুদ পড়তে পারেন।
- তবে উত্তম হলো কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে তারপর ওঠা।
মধ্যরাত
- ইশার পর রাত যত গভীর হয়, তাহাজ্জুদের গুরুত্ব তত বেশি বাড়ে।
- মধ্যরাত থেকে তাহাজ্জুদ পড়ার সময় আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।
রাতের শেষ তৃতীয়াংশ (সর্বোত্তম সময়)
- তাহাজ্জুদ নামাজের সবচেয়ে উত্তম সময় হলো রাতের শেষ তৃতীয়াংশ।
- এই সময় আল্লাহ দুনিয়ার কাছাকাছি আসেন এবং দোয়া কবুল করেন।
এ সময় আল্লাহ বান্দার দোয়া ও মোনাজাত শোনেন এবং ক্ষমা করেন। মনে রাখবেন ফরজ নামাজের পর সবচেয়ে উত্তম নামাজ হলো তাহাজ্জুদ নামাজ।
আরো পড়ুন: পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো মানুষ কে
তাহাজ্জুদ নামাজের রাকাত সংখ্যা
তাহাজ্জুদ নামাজ একটি নফল ইবাদত, যা কমপক্ষে ২ রাকাত এবং সর্বোচ্চ ১২ রাকাত পর্যন্ত আদায় করা যায়। কেউ চাইলে তার সামর্থ্য ও সময় অনুযায়ী যেকোনো সংখ্যা পড়তে পারেন। নিচে তাহাজ্জুদ নামাজের রাকাত সংখ্যা নিয়ে বিস্তারিত তুলে ধরা হলো-
সর্বনিম্ন রাকাত সংখ্যা
সর্বনিম্ন ২ রাকাত তাহাজ্জুদ নামাজ পড়া যায়।
যারা নিয়মিত তাহাজ্জুদ পড়তে অভ্যস্ত নন, তারা ২ রাকাত দিয়ে শুরু করতে পারেন। পরে আস্তে আস্তে বাড়িয়ে পড়বেন।
সর্বাধিক রাকাত সংখ্যা
সর্বাধিক ১২ রাকাত পর্যন্ত পড়া যায়।
হাদিসে বিভিন্ন বর্ণনায় ৮, ১০, ১২ রাকাত পড়ার কথা এসেছে।
হাদিসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ (সা.) সাধারণত ৮ রাকাত তাহাজ্জুদ পড়তেন। তিনি কখনো কখনো ১০ বা ১২ রাকাতও পড়তেন। এরপর তিনি ১ বা ৩ রাকাত বিতর নামাজ পড়তেন।
আরো পড়ুন: আসসালামু আলাইকুম অর্থ
প্রতি ২ রাকাত করে তাহাজ্জুদের নামাজ পড়া উত্তম
আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত,
“রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: ‘তোমাদের মধ্যে কেউ যখন রাতে নামাজ পড়ে, তখন তা দুই রাকাত করে পড়বে।’” (সহিহ বুখারি, ৯৯০)
তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ত Tahajjud Namaz Niyat
নিয়ত মূলত অন্তরের একটি ইচ্ছা বা সংকল্প, যা মুখে বলা জরুরি নয়। তবে যদি কেউ মুখে উচ্চারণ করতে চান, বাংলায় অথবা আরবিতে যে কোন ভাবে পড়লেই হবে।
তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ত বাংলা উচ্চারণ
তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ত বাংলায়
মুখে বলা জরুরি নয়, মনে স্থির করলেই নিয়ত হয়ে যায়। নিয়ত করার সময় অন্তরে এই কথা রাখতে হবে যে, আমি শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করছি। যদি কেউ ৪, ৬, ৮ বা ১২ রাকাত তাহাজ্জুদ পড়তে চান, তাহলে নিয়ত পরিবর্তন করে নিতে পারেন।
বিভিন্ন রাকাতের জন্য বাংলায় নিয়ত
২ রাকাত তাহাজ্জুদের নিয়ত:
আমি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ২ রাকাত তাহাজ্জুদ নফল নামাজ পড়ার নিয়ত করছি।
৪ রাকাত তাহাজ্জুদের নিয়ত:
আমি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ৪ রাকাত তাহাজ্জুদ নফল নামাজ পড়ার নিয়ত করছি।
৮ রাকাত তাহাজ্জুদের নিয়ত:
আমি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ৮ রাকাত তাহাজ্জুদ নফল নামাজ পড়ার নিয়ত করছি।
তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ার সঠিক নিয়ম
তাহাজ্জুদ নামাজ এশার নামাজের পর এবং ফজরের আজানের আগে পড়তে হয়। নিচে তাহাজ্জুদ নামাজের সঠিক নিয়ম বর্ণনা করা হয়েছে-
তাহাজ্জুদ নামাজে দুই রাকাতের করে পড়ার নিয়ম-
প্রথম রাকাত যেভাবে পড়বেন
- নিয়ত করুন।
- তাকবির (আল্লাহু আকবার) বলুন।
- সানা পড়ুন (সুবহানাকাল্লাহুম্মা…)।
- সুরা ফাতিহা পড়ুন।
- সূরা ফাতিহার পর যেকোনো ছোট সূরা পড়ুন।
- রুকু, সিজদা আদায় করুন।
দ্বিতীয় রাকাত যেভাবে পড়বেন
- সুরা ফাতিহা পড়ুন।
- সূরা ফাতিহার পর যেকোনো সূরা পড়ুন।
- রুকু, সিজদা, এবং তাশাহহুদ পড়ে সালাম ফিরিয়ে নামাজ শেষ করুন।
এইভাবে প্রতি দুই রাকাত করে তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করুন। আপনি চাইলে একসাথে ৪ এবং ৮ রাকাত ও পড়তে পারেন।
আরে পড়ুন: আয়াতুল কুরসি বাংলা উচ্চারণ
তাহাজ্জুদ নামাজের দোয়া
তাহাজ্জুদ নামাজ শেষে আল্লাহর কাছে মন খুলে দোয়া করুন, কারণ এই সময় আল্লাহ বান্দার দোয়া কবুল করেন। কিছু দোয়া পড়া যেতে পারে—
রাসূলুল্লাহ (সা.) এর দোয়া:
“হে আল্লাহ! তুমি ক্ষমাশীল, তুমি ক্ষমা করতে ভালোবাসো, তাই আমাকে ক্ষমা করো।” (তিরমিজি)
আপনি চাইলে নিজেয় অন্য কোন দোয়া পড়তে পারেন।
তাহাজ্জুদ নামাজের ফজিলত
তাহাজ্জুদ নামাজ হলো রাতের গভীরে আল্লাহর সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপনের একটি উত্তম সুযোগ। এটি একটি নফল ইবাদত, তবে ইসলামে এর গুরুত্ব এত বেশি যে, এটি নিয়মিত আদায় করলে আল্লাহ বান্দাকে বিশেষ মর্যাদা দান করেন।
শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা লাভ হয়: গবেষণায় দেখা গেছে, তাহাজ্জুদ পড়লে মানসিক চাপ কমে, একাগ্রতা বৃদ্ধি পায় এবং মনোবল দৃঢ় হয়।
কঠিন বিপদ ও দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি দেয়: আল্লাহর রহমত পাওয়ার অন্যতম উপায় হলো তাহাজ্জুদ নামাজ।
আত্মার প্রশান্তি ও মানসিক শান্তি দেয়: যারা নিয়মিত তাহাজ্জুদ পড়েন, তাদের হৃদয়ে এক বিশেষ প্রশান্তি অনুভূত হয়। দুশ্চিন্তা, হতাশা ও মানসিক অস্থিরতা দূর হয়।
জান্নাতের মর্যাদা লাভের অন্যতম মাধ্যম: রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: “হে লোকেরা! সালাম প্রচার করো, মানুষকে খাদ্য দান করো, আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখো এবং রাতে যখন মানুষ ঘুমিয়ে থাকে, তখন নামাজ পড়ো। তাহলে তোমরা শান্তিতে জান্নাতে প্রবেশ করবে।”(তিরমিজি, ২৫৪১)
আল্লাহর ভালোবাসা অর্জনের সুযোগ: আল্লাহ তায়ালা বলেন: “তারা রাতের সামান্য অংশেই নিদ্রা যেত এবং শেষ রাতে তারা ক্ষমা প্রার্থনা করত।” (সূরা আয-যারিয়াত: ১৭-১৮)
পাপ মোচনের বড় সুযোগ: তাহাজ্জুদ নামাজের মাধ্যমে আল্লাহ বান্দার পাপ ক্ষমা করে দেন। নিয়মিত তাহাজ্জুদ আদায় করলে পূর্বের গুনাহ মাফ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
জান্নাতে উচ্চ মর্যাদা লাভের সুযোগ: তাহাজ্জুদ আদায়কারী ব্যক্তির জন্য জান্নাতে বিশেষ মর্যাদা নির্ধারিত রয়েছে।
মুখের নূর ও হৃদয়ের প্রশান্তি বাড়ায়: নিয়মিত তাহাজ্জুদ পড়লে মুখমণ্ডলে নূর ফুটে ওঠে এবং মন প্রশান্ত থাকে।
গোপন দোয়া কবুল হওয়ার সম্ভাবনা বেশি: রাতের শেষ ভাগে আল্লাহর কাছে করা দোয়া দ্রুত কবুল হয়।
তাহাজ্জুদ নামাজ আল্লাহর সঙ্গে গভীর সম্পর্ক গড়ার এক মহৎ ইবাদত।এটি গুনাহ মোচন করে এবং জান্নাতে উচ্চ মর্যাদা দেয়।রাতের শেষ তৃতীয়াংশে তাহাজ্জুদ পড়া সবচেয়ে উত্তম সময়।আল্লাহ আমাদের সবাইকে তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ার তাওফিক দান করুন, আমিন!
আরো পড়ুন: পৃথিবীর প্রথম ধর্ম কোনটি
কিছু কমন প্রশ্ন
তাহাজ্জুদ নামাজ কি প্রতিদিন পড়তে হয়?
তাহাজ্জুদ নামাজ প্রতিদিন পড়া বাধ্যতামূলক নয়, তবে এটি উত্তম সুন্নত এবং নফল নামাজ, যা আদায় করলে অনেক সওয়াব পাওয়া যায়।
এশার নামাজ না পড়ে কি তাহাজ্জুদ নামাজ পড়া যাবে?
না, ইশার নামাজ না পড়েই তাহাজ্জুদ নামাজ পড়া উচিত নয়।
তাহাজ্জুদ নামাজ কি ঘুম থেকে উঠে পড়তে হয়?
হ্যাঁ, তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করতে হলে সাধারণত ঘুম থেকে উঠে নামাজ পড়তে হয়। এটি একটি রাত্রিকালীন নামাজ, যার জন্য ব্যক্তি রাতের ঘুম থেকে উঠতে হয় এবং এরপর তাহাজ্জুদ নামাজ পড়তে হয়।
তাহাজ্জুদ নামাজ কখন পড়তে হয়?
এশার নামাজের পর থেকে ফজরের আজানের আগ পর্যন্ত যেকোনো সময় তাহাজ্জুদ পড়া যায়।
তাহাজ্জুদ নামাজ কত রাকাত?
তাহাজ্জুদ নামাজের নির্দিষ্ট রাকাত সংখ্যা নেই। এটি ২ রাকাত থেকে শুরু করে ১২ রাকাত পর্যন্ত আদায় করা যায়। তবে রাসূলুল্লাহ (সা.) সাধারণত ৮ বা ১১ রাকাত পড়তেন।
তাহাজ্জুদ এর নামাজ সুন্নত নাকি নফল?
তাহাজ্জুদ নামাজ নফল ইবাদত, তবে এটি সুন্নাতে মুস্তাহাব (উত্তম সুন্নত)। অর্থাৎ, এটি বাধ্যতামূলক নয়, কিন্তু আদায় করলে বিশাল সওয়াব পাওয়া যায়।
তাহাজ্জুদ নামাজ আগে নাকি বিতর নামাজ আগে পড়তে হয়?
তাহাজ্জুদ আগে, বিতর নামজ পরে পড়া উচিত।
এশার নামাজের পর তাহাজ্জুদ নামাজ পড়া যাবে কি?
হ্যাঁ, এশার নামাজের পর তাহাজ্জুদ নামাজ পড়া যাবে।
আরো পড়ুন: নবীর স্ত্রীদের নাম
রাতের শেষ অংশে আল্লাহর দরবারে দাঁড়িয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করা, নিজের প্রয়োজন আল্লাহর কাছে তুলে ধরা এবং দোয়া কবুল হওয়ার এই সুবর্ণ সুযোগ আমাদের হাতছাড়া করা উচিত নয়। আমরা যেন নিয়মিত তাহাজ্জুদ নামাজ আদায়ের অভ্যাস গড়ে তুলতে পারি এবং আল্লাহর বিশেষ রহমত ও বরকত অর্জন করতে পারি—এটাই আমাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য হওয়া উচিত।